Friday, March 29, 2024
Google search engine
সুস্থ থাকুনজন্ডিস থেকে বাঁচতে কি করবেন আর কি খাবেন।

জন্ডিস থেকে বাঁচতে কি করবেন আর কি খাবেন।

লিভার রোগ এ দেশে হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি। অথচ সামান্য সচেতন থাকলেই আমরা লিভারের অধিকাংশ জটিল রোগ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি।
জন্ডিস থেকে বাঁচতে : –
জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি রোগের লক্ষণ। লিভারের সমস্যা ছাড়াও রক্তের রোগ, ক্যান্সার বা পিত্তের স্বাভাবিক প্রবাহ পাথর বাধাপ্রাপ্ত হলেও জন্ডিস হতে পারে। তবে জন্ডিস বলতে সাধারণত আমরা লিভারের একিউট প্রদাহ বা একিউট হেপাটাইটিসজনিত জন্ডিসকেই বুঝে থাকি। ভাইরাস থেকে শুরু করে নানা ধরনের ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল, অ্যালকোহল ইত্যাদি অনেক কারণেই লিভারে একিউট হেপাটাইটিস হতে পারে। তবে আমাদের দেশে একিউট হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’, ‘এ’ এবং ‘বি’ ভাইরাস। এর মধ্যে প্রথম দুটি পানি ও খাদ্যবাহিত আর তৃতীয়টি ছড়ায় মূলত রক্তের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস প্রধানত শিশুদের জন্ডিসের কারণ।
তবে যেকোনো বয়সের মানুষই হেপাটাইটিস ‘ই’ ও ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই সব সময় তো বটেই, বর্ষা মৌসুমে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকতে হবে। এতে শুধু হেপাটাইটিস ‘এ’ বা ‘ই’-ই নয়, বরং টাইফয়েড আর ডায়রিয়ার মতো আরো অনেক পানিবাহিত রোগ থেকেই বাঁচা যাবে । আখের রস আমাদের দেশে জন্ডিসের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধ।
অথচ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তার পাশের যে দূষিত পানিতে আখ ভিজিয়ে রাখা হয় সে পানি থেকেই অনেক সময় আখের রসে এবং তারপর ওই রস থেকে হেপাটাইটিস ‘এ’ বা ‘ই’ ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে। বাইরের খাবার পরিহার করা উচিত। যদি খেতেই হয়, তবে তা অবশ্যই গরম খাওয়া উচিত। ফুচকা, চটপটি, বোরহানি আর সালাদের ব্যাপারে বেশি সতর্কতা দরকার। কারণ হেপাটাইটিস ‘এ’ বা ‘ই’-এর মতো পানি ও খাদ্যবাহিত ভাইরাসগুলো এসবের মাধ্যমেই ছড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের খুব সাবধান থাকা উচিত। আর গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে যদি হেপাটাইটিস ‘ই’ হয়, তবে তা থেকে মা ও গর্ভের শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা ৫০ শতাংশেরও বেশি।
জন্ডিসের রোগীদের সঙ্গে একই প্লেট-বাসন বা গ্লাসে খাবার বা পানি খাওয়া যাবে কি না এটি জন্ডিস রোগীর আত্মীয়স্বজনের একটি বড় প্রশ্ন। যেসব ভাইরাসের মাধ্যমে একিউট হেপাটাইটিসজনিত জন্ডিস হতে পারে, তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাস দুটি খাদ্য ও পানিবাহিত হলেও এই দুটি ভাইরাসের কারণে রোগীর যত দিনে জন্ডিস দেখা দেয়, তখন তার কাছ থেকে আর ওই ভাইরাস দুটি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে।
কাজেই জন্ডিস রোগীর সঙ্গে প্লেট-বাসন শেয়ার করার মাধ্যমে কারো এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ঠিক তেমনিভাবে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত মাও নিশ্চিন্তে তার সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে পারেন। অন্যদিকে রক্তবাহিত হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে চাইলে ছোট-বড়, গরিব-ধনী নির্বিশেষে সবার অবশ্যই উচিত এই ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা নেওয়া। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে কোনো না কোনো সময় ইনফেক্টেড হয়েছেন।
ভ্যাকসিনেশন হেপাটাইটিস ‘বি’ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান, হেপাটাইটিস ‘বি’ রোগীর স্বামী বা স্ত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং থেলাসেমিয়া ও অন্যান্য হেমোলাইটিক এনিমিয়ার ও কিডনি ডায়ালিসিসের রোগীদের জন্য হেপাটাইটিস ‘বি’-এর ভ্যাকসিন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে ভ্যাকসিনটি নিতে হবে কোনো ভালো জায়গা থেকে। কারণ, ঠিকমতো সংরক্ষণ করা না হলে এই ভ্যাকসিন কোনো উপকারেই আসে না।
দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের মাধ্যমে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে অনেকেই নিজেদের অজান্তে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। তা ছাড়া একই শেভিং রেজর, ব্লেড কিংবা ক্ষুর ব্যবহারের মাধ্যমেও ভাইরাস দুটি ছড়াতে পারে। তবে স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে ছড়ালেও গর্ভস্থ শিশুর হেপাটাইটিস ‘বি’ কিংবা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
মায়ের যদি হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসজনিত জন্ডিস হয়ে থাকে, তবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন ইনজেকশন দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ মায়ের দুধের মাধ্যমে না ছড়ালেও মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে শিশুর হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সামাজিক মেলামেশা যেমন হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি এবং রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামাকাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে হেপাটাইটিস ভাইরাস ছড়ায় না।
দূরে রাখুন ফ্যাটি লিভার :–
ফ্যাটি লিভার খুবই কমন একটি রোগ। আক্ষরিক অর্থেই এ রোগে লিভারে চর্বি জমতে থাকে, যা থেকে কারো কারো লিভার সিরোসিস বা এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। সাধারণত আলট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, আমাদের ফ্যাটি লিভার আছে বা লিভারে চর্বি জমেছে মেদ ভুঁড়ি এ রোগের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে চর্বি বেশি থাকা ইত্যাদি এ রোগের অন্যতম কারণ। আর তাই ফ্যাটি লিভার থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান দিকটাই হচ্ছে লাইফ-স্টাইল মডিফিকেশন যেমন নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম করা এবং পাশাপাশি খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া।
শুধু যে রেড মিট যেমন খাসি বা গরুর মাংস, ডিমের কুসুম, চিংড়ি মাছ, পনির, মাখন, বিরিয়ানি ইত্যাদি হাই ফ্যাট খাবার পরিহার করতে হবে তা-ই নয়, পাশাপাশি অতিরিক্ত শর্করা যেমন ভাতের ব্যাপারেও হতে হবে খুব সাবধান। কারণ অতিরিক্ত শর্করাযুক্ত খাবার খেলে তা লিভারে গিয়ে চর্বি হিসেবেই জমা হতে থাকে। একইভাবে সাবধান থাকতে হবে ফাস্ট ফুড এবং জাঙ্ক ফুডের ব্যাপারেও। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের পর ফ্যাটি লিভারই এখন এ দেশে ক্রনিক লিভার ডিজিজের প্রধান কারণ। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীদের হার্ট ডিজিজ বা ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি থাকে।
লিভার সিরোসিসেও ভালো থাকুন :–
সিরোসিসে লিভারের স্বাভাবিক গঠন এবং একটা পর্যায়ে কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এ দেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস। এ ছাড়া ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস, অ্যালকোহলসহ অনেক কারণেই লিভার সিরোসিস হতে পারে। লিভার সিরোসিসের অনেকগুলো কমপ্লিকেশনের অন্যতম হচ্ছে এসাইটিস বা পেটে পানি আসা। এসব রোগীকে তরল এবং লবণ মেপে খাওয়া জরুরি।
তরকারিতে যতটুকু লবণ দেওয়া হয়, তার বেশি লবণ এ ধরনের রোগীদের খাওয়া উচিত না। অনেকের ধারণা, লবণ ভেজে খেলে সমস্যা নেই। এ ধারণাটাও ঠিক না। কারণ সমস্যা আসলে লবণে না; বরং সোডিয়ামে। এই সোডিয়াম আমরা মূলত দুইভাবে খেয়ে থাকি- সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাওয়ার লবণ এবং সোডিয়াম বাই কার্বোনেট বা বেকিং পাউডার হিসেবে। সে জন্যই এসাইটিসের রোগীদের বেকারি আইটেম যেমন বিস্কুট, কেক ইত্যাদি এবং ফিজি ড্রিংকস যেমন কোক, পেপসি ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত। এসাইটিসের রোগীরা যদি বেশি বেশি তরল পান করেন বা সোডিয়ামযুক্ত খাবার খান, তাহলে তাদের পেটের পানি বাড়বে বই কমবে না।
লিভার সিরোসিসের আরেকটি মারাত্মক জটিলতা হলো হেপাটিক কোমা- সহজ কথায় বলতে গেলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। প্রাণিজ আমিষ যেমন মাছ-মাংস, ডিম-দুধ ইত্যাদি খুব বেশি পরিমাণে খেলে রক্তে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে রোগীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ডিকম্পেনসেটেড বা অ্যাডভান্সড লিভার সিরোসিসের রোগীদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তবে প্লান্ট প্রোটিন, যেমন ডাল এ ধরনের রোগীর জন্য নিরাপদ। তাই বলে অতিরিক্ত সতর্ক হতে গিয়ে প্রাণিজ আমিষ একেবারেই বাদ দিলে চলবে না। সে ক্ষেত্রে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে কিডনি ফেইলিওর হতে পারে।
পাশাপাশি লিভার সিরোসিসের রোগীদের বাইরের খাবার এবং ফুটানো নয় এমন পানি পান করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ তাদের লিভারে যদি হেপাটাইটিস ‘এ’ বা ‘ই’ ভাইরাসের মতো পানি ও খাদ্যবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তবে তাদের খুব সহজেই একিউট অন ক্রনিক লিভার ফেইলিওরের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
লিভার সিরোসিস এবং আরো সহজভাবে বলতে গেলে লিভারের যেকোনো রোগীরই অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। অ্যালকোহল নিজেই অ্যালকোহলিক লিভার সিরোসিস তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি যাঁরা অ্যালকোহল গ্রহণ করেন তাঁদের লিভার অ্যাবসেস বা লিভারে ফোড়া হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। গবেষণায় এও দেখা গেছে যে অ্যালকোহল গ্রহণ করলে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার রোগের মাত্রাও অনেক বৃদ্ধি পায়।

জেনে রাখা দরকার :-
জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি রোগের লক্ষণ। লিভারের সমস্যা ছাড়াও রক্তের রোগ, ক্যান্সার বা পিত্তের স্বাভাবিক প্রবাহ পাথর বাধাপ্রাপ্ত হলেও জন্ডিস হতে পারে।
দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের অজান্তে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তা ছাড়া একই শেভিং রেজর, ব্লেড কিংবা ক্ষুর ব্যবহারের মাধ্যমেও ভাইরাস দুটি ছড়াতে পারে।
আমাদের দেশে একিউট হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’, ‘এ’ এবং ‘বি’ ভাইরাস। এর মধ্যে প্রথম দুটি পানি ও খাদ্যবাহিত আর তৃতীয়টি ছড়ায় মূলত রক্তের মাধ্যমে।
লিভারে চর্বি জমতে থাকলে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।

আরও পড়ুন-

এমন আরও কিছু আর্টিকেল

Google search engine

জনপ্রিয়