খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বুক চিড়ে চলছিল এক ছোট্টো জাহাজ। সেই জাহাজের এক নাবিক সর্বক্ষণ সমুদ্রের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কারণ এই নাবিকের একটু ভুলভাল হলেই ঘটে যেতে পারে বিশাল কোনো অনর্থ, যার খেসারত দিতে হতে পারে জাহাজ ভর্তি যাত্রীদের। যাহোক..আমাদের এই নাবিক তেমন কোনো ভুল করলেন না, উল্টো নির্বিঘ্নেই চলছিল জাহাজ। কিন্তু প্রায় হঠ্যাৎই কোনো ডুবু চর ছাড়াই জাহাজটি যেন বিশাল কিছু সঙ্গে ধাক্কা খেলো। দুলে উঠলো গোটা জাহাজ। শুধু আমাদের নাবিক নয়, জাহাজের সবাই শঙ্কিত হয়ে উঠলো আসন্ন দুর্ঘটনার কথা ভেবে। কিন্তু সবার জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষমেষ কিছুই হয়নি। তবে এতোকিছুর মাঝেও আমাদের নাবিক ঠিক কিছু একটা দেখেছিলেন সমুদ্রে, যাতে জাহাজটি ধাক্কা লেগেছিল। কি সেই বিশাল বস্তু বা জন্তু?
সেই নাবিকের রহস্য ভেদ না হলেও, দীর্ঘদিন পের একটা রহস্য ভেদ হয়েছিল যে, কেন সমুদ্রে প্রায়ই কোনো ক্ষতি ছাড়াই জাহাজগুলো ধাক্কা খায়। প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানান দিলেন যে, সমুদ্রের বুকে সাতার কেটে বেড়ানো এক প্রকার প্রাণী, যাকে সমুদ্রের গরু বলা যায়, এই গরুর শরীরের সঙ্গেই সমুদ্রের জাহাজগুলো ধাক্কা খেতো। তবে প্রাণী বিজ্ঞানীদের ওই দাবি যে খুব সহজেই তৎকালীন ইউরোপের মানুষ মেনে নিয়েছিল তা নয়। কিন্তু অজ্ঞানতার অন্ধকার যত কাটতে থাকে, মানুষ ততই প্রাণীবিজ্ঞানীদের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে।
আমরা এতক্ষণ যে সামুদ্রিক প্রাণীটির কর্মকাণ্ডের বর্ননা দিলাম, এর আয়তন প্রায় দশ মিটার লম্বা। আর ওজনে এরা প্রায় পাঁচ থেকে দশ টন পর্যন্ত হয়। সমুদ্রের তলায় জন্মানো ঘাষ হলো সামুদ্রিক গরুর খাবার। বর্তমানে বিজ্ঞানী স্টেলারের নামানুসারে এই প্রাণীটির নাম দেয়া হয়েছে স্টেলার’স কাউ। তবে এই গরু সম্পর্কে খুব বেশি একটা আমাদের জানাতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। কারণ আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগেই এরা পৃথিবীর বিশাল জলরাশি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আজও অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, সামুদ্রিক গরু আসলে কোনোদিনই ছিল না, এটা স্রেফ কল্পকাহিনী মাত্র। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এই গরু একদা এই পৃথিবীতেই ছিল এবং বিভিন্ন ঘটনার ভেতর দিয়ে তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে।
বিজ্ঞানীরা এখনও সমুদ্রের গরু সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একঠি ভিন্ন জাত সিরেনিয়া অর্ন্তভূক্ত ছিল ওই গরুরা। গ্রিক মিথলজি অনুযায়ী এই গরুদের প্রজাতির নামকরণ করা হয়। তবে বর্তমানে এই প্রজাতির আরও চারটি প্রাণী বেঁচে আছে। এরমধ্যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ডুগং(তিন মিটার দৈর্ঘ্য, ৪০০ কিলোগ্রাম ওজন) একটি। মানাতি প্রজাতির আরও তিনটি প্রানী রয়েছে, আমাজনিয়া মানাতে, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মানাতে এবং ওয়েস্ট আফ্রিকান মানাতে। এরা প্রত্যেকেই চার মিটার লম্বা এবং ওজন হয় প্রায় ৬০০ কিলোগ্রামের কাছাকাছি। আর এরা প্রত্যেকেই মোটামুটি ডুগংয়ের মতো দেখতে।
কিন্তু স্টেলার’র কাউ ছিল আরও অনেক অনেক বড়। স্বাভাবিকভাবেই এরা ১০ মিটার লম্বা হতো, তবে অনেকে বলেন যে এরা আরও লম্বা ছিল এবং এদের ওজন ছিল চার হাজার থেকে এগার হাজার কিলোগ্রাম। এছাড়াও এদের ছিল শক্ত দাত, যা খাবার পিষে ফেলতে সাহায্য করতো। সর্বপ্রথম ১৭৪১ সালে এই সামুদ্রিক গরুদের সন্ধান পাওয়া যায়। রাশিয়ার নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভিটুস বেরিং তার জাহাজ নিয়ে যাওয়ার সময় একটি বৃক্ষহীন দ্বীপ দেখতে পান। সেই দ্বীপের আশেপাশের পানিতে তার প্রথম ওই গরুদের দেখতে পেয়েছিলেন। আজকে আমরা যে বেরিং সাগর চিনি, সেটির নামকরণ করা হয়েছিল ওই ক্যাপ্টেন ভিটুসে বেরিংয়ের নামানুসারে।